অনলাইন রিপোর্ট॥ঘনঘন লোডশেডিং ফিরিয়েছে পানির পুরনো সঙকট।পুরান ঢাকার শাঁখারীবাজারে রাস্তার লাইন থেকে পানি নিতে মানুষের ভিড়।বিদ্যুতের লোডশেডিং বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রাজধানীর কিছু এলাকায় ওয়াসার পানির পুরনো সঙ্কট ফিরে এসেছে।
ঢাকার মহাখালী, দক্ষিণ দনিয়া, কাদেরাবাদ হাউজিং এলাকা, বায়তুল আমান হাউজিং, উত্তর বাড্ডার গুদারাঘাট এলাকায় আগে থেকেই থাকা পানির সঙ্কট ছিল। গত কয়েক দিনে তা আরও বাড়ায় রান্নাবান্না, গোসল আর নিত্যকার কাজ সারতে দুর্বিষহ পরিস্থিতিতে পড়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।
তারা বলছেন, সরবরাহ লাইনে নিয়মিত পানি আসে না। আবার কোন কোন সময়ে লাইনে পানি থাকলেও দিনে কয়েকবার করে বিদ্যুৎ যাওয়ায় বাসার রিজার্ভারে জমা হওয়া পনি ছাদের ট্যাংকে ওঠানো যায় না।
দক্ষিণ দনিয়া এলাকার একটি বাড়ি মালিক আবদুল্লাহ আল মামুন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, পানির সমস্যা তাদের এলাকায় আগেও ছিল। কিন্তু এখন দিনে কমপক্ষে পাঁচ ঘণ্টা তারা পানি পাচ্ছেন না।
“হাই স্কুলের পাশের পাম্প থেকে আমাদের এলাকায় পানি আসে। কিন্তু সেখানে জেনারেটর নেই, বিদ্যুৎ চলে গেলে পাম্প বন্ধ থাকে। ফলে লাইনে পানি আসে না। আবার লাইনে পানি এলেও লোডশেডিং থাকলে পানি বাসার ট্যাংকে তোলা যায় না। আমরা খুব দুর্বিসহ অবস্থায় আছি।”
রাজধানীর কাদেরাবাদ হাউজিং এলাকায় পানি সঙ্কট চলছিল কিছুদিন ধরে। চলমান লোডশেডিং সেই সমস্যা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে জানান স্থানীয় মৌসুমী আচার্য।“দিনে ৫ থেকে ৬ ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকে না। তখন মোটর চলে না, পানিও আসে না। আবার ওয়াসার গাড়ি দিয়ে পানি কিনে আনলেও সে পানি রিজার্ভারে নেওয়া যায় না।“
এবি আশরাফ উদ্দিন আহমেদ এবং নাসরিন জাহান রাজধানীর বায়তুল আমান হাউজিংয়ের ১১ নম্বর সড়কের বাসিন্দা। তারা জানালেন, ওই এলাকার সরবরাহ লাইনে পানি ‘থাকে না বললেই চলে’। তাই কেনা পানিই ভরসা। কিন্তু তাতে গোসল, খাওয়া, রান্নাবান্নাসহ অন্যান্য কাজের সম্পূর্ণ চাহিদা মেটানো যায় না।
নাসরিন জাহান বলেন, “তিন থেকে সাড়ে তিন মাস হয়ে গেল, লাইনের পানির সমস্যা। সারারাত টানতে হয়, টানলে অল্প পানি আসে। দেখা গেছে একদিন পেলেও পরের দিন পানি আসে না। আমরা এখানে বসবাস করি একুশ বছর। এবারের মত সমস্যা আগে হয়নি।“
এ বিষয়ে ওয়াসায় অভিযোগ করেও সমাধান হয়নি জানিয়ে তিনি বলেন, “গত দুই মাস ধরে পানি কিনে আনছি গাড়ি দিয়ে।”
যা বলছে ওয়াসা
ঢাকা ওয়াসার তথ্য অনুযায়ী, রাজধানীতে দৈনিক পানির চাহিদা ২৪০ থেকতে ২৪৫ কোটি লিটার। এর বিপরীতে ওয়াসার উৎপাদন সক্ষমতা ২৭০ থেকে ২৭৫ কোটি লিটার। ৬৪ শতাংশ পানি ভূগর্ভস্থ উৎস থেকে আসে, বাকী ৩৪ শতাংশ আসে শোধনাগার থেকে। ঢাকা ওয়াসা এলাকায় ৯০৭টি পাম্প রয়েছে। আর জেনারেটর আছে এমন পাম্পের সংখ্যা তিনশর বেশি।
কিন্তু বিদ্যুৎ বিভ্রাট এবং অন্যান্য কারণে চাহিদার ১৫ থেকে ২০ শতাংশ পানি কম উৎপাদন হচ্ছে জানিয়ে ওয়াসার একটি মডস জোনের একজন নির্বাহী প্রকৌশলী বলেন, “সমস্যাটা বেশি হয় লাইনের শেষদিকের বাড়িগুলোর। লাইনে পানির প্রেশার কম থাকায় সেসব বাড়ির মানুষ পানি পায় না। একটা অসম বণ্টন হয়।”
ঢাকা ওয়াসার ১১টি মডস জোনের মাধ্যমে বিভিন্ন এলাকায় পানি সরবরাহ করে। এসব এলাকায় ৯২০টির মত পাম্প আছে। এরমধ্যে ৬০টি পাম্প রাখা হয়েছে ব্যাকআপ হিসেবে। কিছু পাম্পে জেনারেটর আছে। তবে কতগুলো পাম্প জেনারেটরে চলে সে হিসাব পাওয়া যায়নি ঢাকা ওয়াসা থেকে।আগে দিনরাত ২৪ ঘণ্টা চালু থাকত মুন্সিগঞ্জের পদ্মা যশলদিয়া পানি শোধনাগার। বর্তমানে ঘনঘন লোডশেডিংয়ের কারণে সেটি বন্ধ থাকছে দিনের অনেকটা সময়।
ওইয়াসার ওই প্রকৌশলী বলেন, পদ্মা যশলদিয়া পানি শোধনাগার উৎপাদন ক্ষমতা দৈনিক ৪৫ কোটি লিটার হলেও আগে পানি পাওয়া যেত ত্রিশ কোটি লিটার। সেটা কমতে কমতে প্রায় ২০ কোটিতে এসে দাঁড়িয়েছে।
“সেই পানি সরবরাহ করা হয় ঢাকা ওয়াসার ১, ২ ও ৬ নম্বর জোনে। কিন্তু ওই শোধনাগার চালুর পর তিন বছরেও জেনারেটরের ব্যবস্থা করা হয়নি, ফলে লোডশেডিংয়ের সময় শোধনাগারের কাজ বন্ধ থাকে। তাই পানি আরও কম পাওয়া যাচ্ছে।“
তিনি বলেন, আগে অনিয়মিত লোডশেডিং হলেও গত জুলাই মাস থেকে সরকার সূচি ধরে লোডশেডিং দিচ্ছে। ওই সময় থেকেই পানির উৎপাদন কিছুটা কমেছে।
“লোডশেডিংয়ের কারণে ঢাকার মধ্যে আমাদের পাম্পগুলোরও উৎপাদনও কমেছে। ২০ শতাংশ পাম্প বন্ধ থাকলেও পুরো সিস্টেমে তার প্রভাব পড়ে। লাইনে পানি যায় কম। যে পানি যায়, তা টানা পাম্প আছে এমন বাড়ি মালিকরা টেনে নেয়। ফলে বাকিরা পানি পায় না।
“অনেক পাম্পে জেনারেটর আছে। আবার জ্বালানির দাম বাড়ায় সেটাও একটা সমস্যা তৈরি করেছে, জেনারেটরও চালানো যাচ্ছে না নিয়মিত।”
ডেসকোর ওয়েবসাইটে লোডশেডিংয়ের যে সূচি দেওয়া হয়, তাতে দেখা যায়, বিভিন্ন এলাকায় ৩ থেকে ৪ ঘণ্টা করে লোডশেডিং দেওয়া হচ্ছে। ডিপিডিসি এলাকায়ও তিন থেকে চার ঘণ্টা করে লোডশেডিং।উত্তর বাড্ডার স্বাধীনতা সরণি এলাকায় একটি নতুন পাম্প বসানো হয়েছে। প্রতি মিনিটে দুই হাজার লিটার পানি তোলার ক্ষমতা আছে পাম্পটির। তবে লোডশেডিংয়ের কারণে এখন দৈনিক কমপক্ষে দুই ঘণ্টা করে বন্ধ রাখতে হচ্ছে পাম্প। এতে ২ লাখ ৪০ হাজার লিটার পানি কম উঠছে।
ঢাকা ওয়াসার ১১টি মডস জোনের মাধ্যমে বিভিন্ন এলাকায় পানি সরবরাহ করে।
উত্তর বাড্ডার জিএম বাড়ি, মধ্য বাড্ডা, নর্দ্দা, জোয়ারসাহারা, মিরপুরের পশ্চিম আগারগাঁও, রামপুরার হাজীপাড়া এলাকায় কয়েকটি পানির পাম্পের অপারেটাররাও বিদ্যুৎ বিভ্রাটের কারণে পাম্প বন্ধ রাখার কথা জানিয়েছেন। তবে তারা কেউ নাম প্রকাশ করতে চাননি।
ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছুটিতে যুক্তরাষ্ট্রে থাকায় এ বিষয়ে তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি। বর্তমানে ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্বে থাকা উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণ) এ কে এম সহিদ উদ্দিনের দাবি, সঙ্কট অতটা নয়।
“জেনারেটর দিয়ে পাম্প চালানো হচ্ছে। ধরেন কোনো এলাকায় লোডশেডিং চলছে, আমাদের পাম্পেও লোডশেডিং। আমরা তখন জেনারেটর দিয়ে বা মোবাইল জেনারেটর দিয়ে ওই সময় পাম্প চালাই। ওই এক ঘণ্টা চালালেই যথেষ্ট।
“কারণ ওই সময় কেউ পানি টানতে পারে না। আমাদের লাইন পানিতে ভরে থাকে প্রেশার ভালো থাকলে বাসায় পানি যায়। আবার টেনেও পানি নিতে পারে। লোডশেডিংয়ের কারণে আমাদের কোনো অসুবিধা হয় না।”
ওয়াসার এই কর্মকর্তার ভাষ্য, “লোডশেডিং তো সব এলাকায় একসঙ্গে হয় না। আমাদের অনেক পাম্পে ডুয়েল কানেকশন আছে। ফলে কোনো একটি ফিডার থেকে কারেন্ট চলে গেলেও আরেকটি ফিডার থেকে আসে।”
“আমরা একটা পাম্প দিয়ে ২৫ হাজার মানুষকে পানি দিতে পারি। কিন্তু সেখানে যদি লোক হয় আড়াই লাখ, কীভাবে সবার চাহিদা মেটাব? পাম্প বসালে সমাধান হয়, কিন্তু স্থানীয় মানুষ জায়গা দিতে পারে না।”