অতীতে কোনো এক কালে দু’জন ব্যক্তির মধ্যে একটি ঘটনা ঘটেছিল। আল্লাহ তাআলা কুরআন কারীমে সে ঘটনা উল্লেখ করেছেন। কুরআন কারীমে ঘটনাটির বর্ণনা এভাবে শুরু হয়েছে : (হে নবী!) তাদের সামনে সেই দুই ব্যক্তির উপমা পেশ করো, যাদের একজনকে আমি আঙ্গুরের দুটি বাগান দিয়েছিলাম এবং সে দুটিকে খেজুর গাছ দ্বারা ঘেরাও দিয়ে রেখেছিলাম আর বাগান দুটির মাঝখানকে শস্যক্ষেত্র বানিয়েছিলাম। উভয় বাগান পরিপূর্ণ ফল দান করত এবং তাতে কোনো ত্রুটি করত না। আমি বাগান দুটির মাঝখানে একটি নহর প্রবাহিত করেছিলাম। (সূরা কাহফ : ৩২-৩৩)।
আল্লাহ তাআলা বলছেন, দুই ব্যক্তির একজনকে আমি আঙ্গুরের দুটি বাগান দিয়েছিলাম। বাগান দুটির চারপাশে ছিল খেজুর গাছের সারি আর মাঝখানে শস্যক্ষেত্র। উভয় বাগানেই বিপুল পরিমাণ ফল ধরত এবং বাগান দুটির মাঝখানে ছিল বহতা নদী।
আল্লাহ তাআলা সেই ব্যক্তিকে প্রচুর ধন-সম্পদ দান করেছিলেন। একদিন সে তার বাগানে ঢোকার সময় অপর ব্যক্তিকে বলল, আমার অর্থ-বিত্তও তোমার চেয়ে বেশি এবং আমার জনবলও তোমার চেয়ে শক্তিশালী। সে আত্মম্ভরিতায় লিপ্ত হয়ে এ কথাও বলল যে, এ বাগান কখনও ধ্বংস হয়ে যাবে বলে আমি মনে করি না। আমার ধারণা কিয়ামতও কখনো হবে না। আর আমাকে যদি আমার প্রতিপালকের কাছে ফিরে যেতেও হয়, তাহলেও নিশ্চিত আমি সেখানে এর চেয়েও উত্তম কিছু পাব।
এই ব্যক্তি নিজের বিত্ত-বৈভব ও দলবল নিয়ে গর্ব করত ও অন্যদেরকে তুচ্ছ মনে করত। আখেরাত ভুলে পার্থিব ধন-সম্পদে বিভোর হয়ে পড়েছিল। আল্লাহ তাআলা তার এই স্বভাব-চরিত্রকে এভাবে ব্যক্ত করেছেন যে, সে নিজের ওপর জুলুম করছিল। তখন অপর ব্যক্তি বলল : তুমি কি সেই সত্তার সাথে কুফরী আচরণ করছ, যিনি তোমাকে মাটি ও তারপরে শুক্রবিন্দু থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং পরবর্তীতে একজন সুস্থ-সবল মানুষ বানিয়েছেন? আমি কিন্তু বিশ্বাস করি আল্লাহ্ই আমার প্রতিপালক এবং আমি তাঁর সাথে কাউকে শরীক করি না।
সে আরো বলল, আচ্ছা, তুমি যখন তোমার বাগানে প্রবেশ করছিলে, তখন কেনো বললে না : আল্লাহ যা চান তাই হয়। আল্লাহর তাওফীক ছাড়া কারো কোনো ক্ষমতা নেই। এরপরে সে বলল, তুমি যদি মনে করো আমার সম্পদ ও সন্তান তোমার চেয়ে কম, তাহলে মনে রেখ, আমার প্রতিপালকের পক্ষে অসম্ভব নয়, তিনি আমাকে তোমার বাগানের চেয়েও উৎকৃষ্ট জিনিস দান করবেন। আর কোনো আসমানী দুর্যোগ পাঠিয়ে তোমার বাগানকে মরু বিয়াবান বানিয়ে দেবেন। এতে যে নদী বয়ে যাচ্ছে, তার পানি ভূগর্ভে নেমে যাবে, তুমি তা খুঁজেও পাবে না।
তারপর যা ঘটল, কুরআনে তা এভাবে বর্ণিত হয়েছে : তার সমুদয় সম্পদ আযাববেষ্টিত হয়ে গেল এবং তার ভোর হলো এমন অবস্থায় যে, বাগানে যা কিছু ব্যয় করেছিল তজ্জন্য শুধু আক্ষেপ করতে লাগল যখন তার বাগান মাচানসহ ভূমিসাৎ হয়েছিল। সে বলছিল, হায়! আমি যদি আমার প্রতিপালকের সাথে কাউকে শরীক না করতাম! আর আল্লাহ ছাড়া তার এমন কোনো দলবল মিলল না, যারা তাকে সাহায্য করতে পারে আর সে নিজেও নিজেকে রক্ষা করতে সমর্থ ছিল না। এরূপ পরিস্থিতিতে (মানুষ উপলব্ধি করতে পারে) সাহায্য করার ক্ষমতা কেবল পরম সত্য আল্লাহরই আছে। তিনিই উত্তম পুরস্কার দান করেন এবং উত্তম পরিণাম প্রদর্শন করেন। (সূরা কাহফ : ৪২-৪৪)।
যে ব্যক্তি নিজের আঙ্গুর বাগান ও অর্থ-সম্পদ নিয়ে গর্ব করেছিল এবং আল্লাহ তাআলার সঙ্গে কুফরী করেছিল, তার ওপর আল্লাহর আযাব নেমে আসল। এক সকালে দেখল, আঙ্গুর বাগান মাচানসহ ধসে গেছে। সমস্ত সম্পত্তি ধ্বংস হয়ে গেছে। সে কিছুই রক্ষা করতে পারল না। তখন আফসোস করা ছাড়া তার আর কিছুই করার থাকল না।
সে বলতে লাগল, হায়! আমি যদি আমার প্রতিপালকের সাথে কাউকে শরীক না করতাম! সে উপলব্ধি করতে পারল, আল্লাহ তাআলাই উত্তম দাতা এবং কেবল তিনিই সাহায্য করতে পারেন। তিনি ছাড়া কারো সাহায্য করার ক্ষমতা নেই এবং তিনিই উত্তম প্রতিদান দান করেন। আল্লাহ তাআলা কুরআনে সূরা কাহফের ৩২ থেকে ৪৪ নম্বর পর্যন্ত আয়াতসমূহে এ ঘটনা বর্ণনা করেছেন।
এই দুই ব্যক্তির ঘটনা সকলের জন্যই অনেক শিক্ষণীয়। ধন-সম্পদ অনেক সময় মানুষকে এভাবেই বিপথগামী করে ফেলে। অহংকারী করে তোলে। সম্পদের মোহে পড়ে কেউ কেউ মহান আল্লাহকে ভুলে যায়, যিনি সম্পদ দান করেছেন। যেখানে তার বেশি বেশি শোকর আদায় করার কথা, এ নিআমতের যথাযথ হক আদায় করার কথা, যেন আল্লাহ তাআলা এ নিআমত বহাল রাখেন।
অথচ সে শোকরগোযারী ভুলে আত্মম্ভরিতায় লিপ্ত হয়ে আল্লাহ তাআলার অবাধ্যতা করে। সে নিজের প্রতিও জুলুম করে, অন্যদের প্রতিও জুলুম করে। তার মনে থাকে না যে, আল্লাহ তাআলা চাইলে মুহূর্তেই এ সম্পদ ধ্বংস করে দিতে পারেন। যেমন এ ঘটনায় এক ব্যক্তির ক্ষেত্রে ঘটেছে।