ভারতের উত্তরপ্রদেশের সামভালে মুঘল আমলে তৈরি একটি মসজিদ ঘিরে তৈরি হওয়া রক্তক্ষয়ী সংঘাতে নিহতের সংখ্যা বেড়ে চারজনে দাঁড়িয়েছে। শতাব্দি প্রাচীন এই মসজিদের স্থানে মন্দির ছিল বলে হিন্দুদের দাবির পর রোববার সেখান সরকারি কর্মকর্তাদের সমীক্ষা চালানোর সময় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।
সামভালে হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মাঝে বিক্ষোভ-সহিংসতায় চারজনের প্রাণহানির পর ওই এলাকায় ইন্টারনেট সংযোগ বাতিল ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করেছে কর্তৃপক্ষ। ষোড়শ শতকের ঐহিত্যবাহী শাহী জামা মসজিদে আদালতের নির্দেশে সমীক্ষা চলাকালীন রোববার বিক্ষোভকারীদের সাথে পুলিশের সংঘর্ষ হয়।
উত্তরপ্রদেশ রাজ্য কর্তৃপক্ষ সহিংসতার এই ঘটনায় চারটি মামলা দায়ের করেছে। এর আগে, গত সপ্তাহে স্থানীয় একটি আদালত মসজিদটির স্থানে সমীক্ষা চালানোর আদেশ দেন। মসজিদটি ধ্বংস হয়ে যাওয়া একটি মন্দিরের স্থানে নির্মাণ করা হয়েছে বলে দাবি করে হিন্দুরা একটি পিটিশন দায়েরের কয়েক ঘণ্টা পর সেখানে সমীক্ষার আদেশ দেন আদালত।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শেয়ার করা সংঘর্ষের ভিডিও ও ছবিতে দেখা যায়, মসজিদের চারপাশে জুতো, ইট ও পাথর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। বিক্ষোভকারী মুসলিমরা অভিযোগ করে বলেছেন, পুলিশের গুলিতে অন্তত চারজন মারা গেছেন। কিন্তু কর্তৃপক্ষ এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
ভারতের ইংরেজি দৈনিক দ্য হিন্দুকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সামভালের পুলিশ সুপার কৃষাণ কুমার বলেন, ‘‘সেখানে মানুষের প্রাণ কেড়ে নিতে পারে, এমন কোনও অস্ত্রের ব্যবহার করা হয়নি।
• শাহী জামা মসজিদ সম্পর্কে যা জানা যাচ্ছে
শাহী জামা মসজিদ, যা সামভালের স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে জামা মসজিদ নামেই পরিচিত। শতাব্দী প্রাচীন একটি মসজিদ। সামভালের ঐতিহাসিক এই মসজিদ ঠিক কবে নির্মাণ করা হয়েছিল, তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। হিন্দু পক্ষ আদালতে দাবি করেছে, এটি মুঘল শাসক বাবরের নির্দেশে হিন্দু মন্দিরের জায়গায় তৈরি করা হয়েছিল।
সামভালের ইতিহাস ‘তারিখ-এ সামভাল’ বইয়ের লেখক মাওলানা মোঈদ। তিনি বিবিসি হিন্দিকে বলেছেন, ‘‘বাবর এই মসজিদ মেরামত করিয়েছিলেন। কাজেই এই তথ্য সঠিক নয় যে, মসজিদটি বাবর নির্মাণ করেছিলেন।’’
তার কথায়, ‘‘এটা ঐতিহাসিক সত্য ১৫২৬ সালে লোধী শাসকদের পরাজিত করে বাবর সামভাল সফর করেছিলেন। কিন্তু জামা মসজিদ তিনি নির্মাণ করেননি।’’
মাওলানা মঈদের মতে, সম্ভবত তুঘলক আমলে তৈরি হয়েছিল এই মসজিদ। কারণ তার পর্যবেক্ষণ বলছে মসজিদের নির্মাণশৈলী মুঘল আমলের সঙ্গে মেলে না।
১৯২০ সালে আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার বা পুরাতত্ত্ব বিভাগের অধীনে এই ভবনকে সুরক্ষিত ভবন হিসাবে ঘোষণা করা হয়। এটি জাতীয় গুরুত্বসম্পন্ন ভবনও বটে। আপাতত ভারতীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগের তত্ত্বাবধানে এই মসজিদের জরিপ চলছে।
• পিটিশনে কী বলা হয়েছে
আবেদনকারী মহন্ত ঋষিরাজ গিরির বক্তব্য, ‘‘আমরা বিশ্বাস করি এই মসজিদ যেখানে রয়েছে সেখানে হরিহর মন্দির ছিল। এর কাঠামোও মন্দিরের মতো। আমরা আমাদের মন্দির ফিরে পেতে চাই এবং সেই জন্য আইনি লড়াই করছি।’’
হিন্দু পক্ষের পক্ষে দায়ের করা আবেদনে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়, ভারতীয় প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপ সর্বেক্ষণ, প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপের মেরাঠ জোনের সুপারিনটেনডেন্ট, সামভালের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এবং মসজিদের পরিচালনা কমিটিকে বাদী করা হয়েছে।
পিটিশনে বলা হয়েছে, জামা মসজিদের ভবন আসলে শতাব্দী প্রাচীন হরিহর মন্দির, যা ভগবান কল্কিকে উৎসর্গ করা হয়েছে।
আবেদনকারীরা জানিয়েছেন, ভবিষ্যতে ভগবান কল্কি সম্ভলে অবতীর্ণ হবেন বলেও বিশ্বাস করা হয়। আবেদনকারীদের বক্তব্য, তারা হিন্দু, মূর্তি পূজায় বিশ্বাসী। ওই ভবনে ভগবান শিব ও বিষ্ণুর উপাসক এবং কল্কি অবতারের পুজো করা তাদের অধিকার। এই মসজিদ সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হোক এবং সবাই যাতে অবাধে যাতায়াত করতে পারে সেই আর্জি জানিয়ে আদালতের দ্বারস্থ হয়েছেন তারা।
আদালত এই আবেদন গ্রহণ করে ওইদিনই জরিপের জন্য নোটিশ জারি করে।
মসজিদ ঘিরে বিতর্ক নতুন নয়
এর আগেও এই মসজিদকে কেন্দ্র করে বিতর্ক হয়েছে। ১৯৭৬ সালে মসজিদের ইমামকে হত্যা করা হয়। এই ঘটনায় সেখানে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছিল। ১৯৮০ সালে পার্শ্ববর্তী শহর মোরাদাবাদে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হলে তার উত্তাপ সম্ভলেও পৌঁছায়।
এদিকে, জামা মসজিদের ভবনে একসময় হিন্দু মন্দির ছিল এই দাবি আগেও জানিয়ে এসেছে হিন্দুত্ববাদী সংগঠন। শিবরাত্রির সময় ওই প্রাঙ্গণে নির্মিত কূপের পুজা দেওয়ার চেষ্টা হয় বলেও মুসলিম সংগঠনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। তবে এই প্রথম আদালতে এই মসজিদকে নিয়ে কোনও মামলা দায়ের করা হয়েছে।
মুসলিম পক্ষের আইনজীবী মাসুদ আহমেদ বলেছেন, ‘‘মামলা দায়ের করে এই মসজিদকে বিতর্কিত বানানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। এর আগে এই নিয়ে কোনও মামলা হয়নি।’’
মসজিদ কমিটির পক্ষ থেকে জাফর আলীও একই কথা বলেছেন। তার মতে, ‘‘এই মসজিদ নিয়ে কিন্তু কোনও আইনি বিবাদ নেই। যদিও হিন্দু সংগঠনগুলো মাঝে মাঝেই এই মসজিদ নিয়ে বিবাদ সৃষ্টি করে।’’
আইনজীবী মাসুদ আহমেদ বলছেন, ‘‘বিস্ময়কর বিষয় হলো, মঙ্গলবার বিকেলে আদালতে এই মামলা দায়ের করা হলো, বিরোধীদের বক্তব্য না শুনেই জরিপের নির্দেশ দেওয়া হলো এবং একই দিন সন্ধ্যায় জরিপও করা হলো। অথচ ২৯ নভেম্বর পর্যন্ত সময় রয়েছে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার। এতেই বোঝা যাচ্ছে গোটা পরিকল্পনার আড়ালে একটা বিতর্ক তৈরি করা হচ্ছে। তবে আমরা আইনি লড়াই লড়তে প্রস্তুত। অপরপক্ষের দাবি আদালতে টিকবে না।