ঢাকা ০১:৫৭ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৩ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম :

কাশিয়ানীর ভাটিয়াপাড়া বিজয়ের তিনদিন পর মুক্ত হয়েছিলো

অনলাইন রিপোর্ট॥

১৯৭১ সালে সারা দেশ যখন বিজয়ের আনন্দে আত্মহারা সে সময়ও গোপালগঞ্জের ভাটিয়াপাড়ায় পাক হানাদাররা যুদ্ধ করে যাচ্ছিলো। বিজয়ের তিনদিন পর ১৯ ডিসেম্বর মিত্র ও মুক্তি বাহিনীর ত্রিমুখী আক্রমনে পাকবাহিনীর দখলে থাকা কাশিয়ানী উপজেলার ভাটিয়াপাড়া ওয়্যারলেস স্টেশনের ক্যান্টনমেন্টের পতন ঘটে এবং পাকিস্তানী সেনারা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। মুক্ত হয় কাশিয়ানীর ভাটিয়াপাড়া।

১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে এক প্লাটুন সশস্ত্র পাকসেনা রেলযোগে কাশিয়ানী অদূরবর্তী ভাটিয়াপাড়া ওয়ারলেস সেন্টার দখল করে অবস্থান নেয়। রাজাকারদের সহায়তায় পাকসেনারা ১৩ এপ্রিল আওয়ামী লীগ নেতা কে এম আমজাদ হোসেন, বাগঝাপা গ্রামের মোক্তার শেখ, মাজড়ার হাবিবুর রহমান বাবু মিয়ার বাড়িসহ শতাধিক আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীর ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। মাজড়া গ্রামের জহির উদ্দিন মৌলভীর ছেলে বেলায়েত, যদু মিয়ার স্ত্রী ও বাগঝাপা গ্রামের আক্কাস শেখকে গুলি করে হত্যা করে। পরদিন ১৪ এপ্রিল পোনা গ্রামে ৬টি বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে এবং খোকা মৌলভীসহ ১১ জনকে গুলি করে হত্যা করে।

মে মাসের শেষ দিকে খালিদ ফিরোজ ও আক্কাস হোসেন এর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধা দল এলাকায় গেরিলা যুদ্ধ শুরু করে। জুলাই-আগস্ট মাসে ভারত থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা এলাকায় প্রবেশ করে যুদ্ধ শুরু করে। ওড়াকান্দি মিড হাইস্কুলে কাশিয়ানী মুক্তিযুদ্ধের কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিল গঠন করে ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। ক্যাম্পের দ্বায়িত্বে ছিলেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা নূরুল কাদির জুন্নুর ছোট ভাই ইসমত কাদির গামা। এছাড়াও রামদিয়া এসকে কলেজ, সাজাইল গোপী মহন হাইস্কুল, রাতইল স্কুল, জয়নগর স্কুলসহ অনেক স্থানে মুক্তিযুদ্ধারা ক্যাম্প স্থাপন করে গেরিলা যুদ্ধ শুরু করে। অক্টোবর মাসে উপজেলার ফুকরা লঞ্চঘাট এলাকায় খুলনা থেকে নদী পথে আসা তিন লঞ্চ ভর্তি পাক সেনার সাথে মুক্তি বাহিনীর ৬ ঘণ্টাব্যাপী মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এ সংঘর্ষে পাকবাহিনীর অর্ধশতাধিক সেনা নিহত হয়। বেশ কিছু মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।

গোপালগঞ্জে-ফরিদপুর-নড়াইল জেলার সীমান্তে অবস্থিত এবং ভৌগলিক ও মুক্তিযুদ্ধের দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ রেল স্টেশন ও নদী বন্দর ভাটিয়াপাড়া দখল নিয়ে পাক হানাদার ও মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে লড়াই হয় কয়েক দফা। পাক বাহিনীর ভাটিয়াপাড়া মিনি ক্যান্টনমেন্টটি গোপালগঞ্জের অন্তর্ভূক্ত হলেও গোপালগঞ্জ-ফরিদপুর-নড়াইল অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধাদের লক্ষ্য বস্তু ছিল ভাটিয়াপাড়ার ওই মিনি ক্যান্টনমেন্টটি।

দীর্ঘ ৯ মাসব্যাপী ৬৫ জনের শক্তিশালী পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর একটি গ্রুপ এখানে অবস্থান করে এলাকায় নিরীহ মুক্তিকামী মানুষের উপর নির্যাতন, নিপীড়ন ও হত্যাযজ্ঞ চালায়। অনেক মুক্তিকামী মানুষকে পাকবাহিনী হত্যা করে ভাটিয়াপাড়ার পাড়ে অবস্থিত মধুমতি নদীর পানিতে ফেলে দিতো। ভাটিয়াপাড়ার পাক বাহিনীর ক্যাম্পটি দখল নিয়ে ৬ নভেম্বর দুটি মারাত্মক যুদ্ধ হয়। মুক্তিযোদ্ধা বাবুল, ইসমত কাদির গামার নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর সাথে টানা ১৫ ঘণ্টা পাক বাহিনীর সাথে যুদ্ধ হয়। এ সময় মুক্তিযোদ্ধাদের ঘায়েল করতে পাকবাহিনী আকাশ পথে গুলি ও বোমা বর্ষণ করে। কিন্তু সেদিন অসীম সাহসী মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটেনি। পাকবাহিনী যথেষ্ট ঘায়েল হয় এ যুদ্ধে।

এই ওয়্যারলেস ক্যাম্প দখল নিয়ে দ্বিতীয় দফায় যুদ্ধ হয় ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের দিনে। ৩ দিন যুদ্ধের পর ১৯ ডিসেম্বর খুব ভোরে নড়াইল জেলার দিক থেকে ৮নং সেক্টরের কমান্ডার মেজর মঞ্জুর, নড়াইল জোনের মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার ক্যাপ্টেন হুদা, লে. কর্ণেল জোয়ান, কামাল সিদ্দিকী, গোপালগঞ্জ ও ফরিদপুরের দিক থেকে ক্যাপ্টেন ইসমত কাদির গামা ও বাবুলের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর কমান্ডারগণ সম্মিলিতভাবে ভাটিয়াপাড়ার মিনি ক্যান্টনমেন্টে আক্রমন চালায়।

মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বাত্মক হামলা ও বীরোচিত সাহসী যুদ্ধে অবশেষে ১৯ ডিসেম্বর সকাল ১০টার দিকে মুক্তি ও মিত্র বাহিনীর যৌথ কমান্ডারের কাছে ৬৫ জন পাক সেনা আত্মসর্মপণ করে। এ যুদ্ধে ৬ জন পাক সেনা নিহত হয়। অপরদিকে, কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা নিহত ও আহত হয়। এরপর ভাটিয়াপাড়ার ওয়্যারলেস স্টেশনের মিনি ক্যান্টনমেন্টে উড়ানো হয় লাল-সবুজের পতাকা।
Tag :
আপলোডকারীর তথ্য

কুয়াকাটায় পর্যটকদের জন্য তাঁবুতে রাত্রিযাপনের ব্যবস্থা

কাশিয়ানীর ভাটিয়াপাড়া বিজয়ের তিনদিন পর মুক্ত হয়েছিলো

প্রকাশিত : ০১:১০:৩৯ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৯ ডিসেম্বর ২০২২

অনলাইন রিপোর্ট॥

১৯৭১ সালে সারা দেশ যখন বিজয়ের আনন্দে আত্মহারা সে সময়ও গোপালগঞ্জের ভাটিয়াপাড়ায় পাক হানাদাররা যুদ্ধ করে যাচ্ছিলো। বিজয়ের তিনদিন পর ১৯ ডিসেম্বর মিত্র ও মুক্তি বাহিনীর ত্রিমুখী আক্রমনে পাকবাহিনীর দখলে থাকা কাশিয়ানী উপজেলার ভাটিয়াপাড়া ওয়্যারলেস স্টেশনের ক্যান্টনমেন্টের পতন ঘটে এবং পাকিস্তানী সেনারা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। মুক্ত হয় কাশিয়ানীর ভাটিয়াপাড়া।

১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে এক প্লাটুন সশস্ত্র পাকসেনা রেলযোগে কাশিয়ানী অদূরবর্তী ভাটিয়াপাড়া ওয়ারলেস সেন্টার দখল করে অবস্থান নেয়। রাজাকারদের সহায়তায় পাকসেনারা ১৩ এপ্রিল আওয়ামী লীগ নেতা কে এম আমজাদ হোসেন, বাগঝাপা গ্রামের মোক্তার শেখ, মাজড়ার হাবিবুর রহমান বাবু মিয়ার বাড়িসহ শতাধিক আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীর ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। মাজড়া গ্রামের জহির উদ্দিন মৌলভীর ছেলে বেলায়েত, যদু মিয়ার স্ত্রী ও বাগঝাপা গ্রামের আক্কাস শেখকে গুলি করে হত্যা করে। পরদিন ১৪ এপ্রিল পোনা গ্রামে ৬টি বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে এবং খোকা মৌলভীসহ ১১ জনকে গুলি করে হত্যা করে।

মে মাসের শেষ দিকে খালিদ ফিরোজ ও আক্কাস হোসেন এর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধা দল এলাকায় গেরিলা যুদ্ধ শুরু করে। জুলাই-আগস্ট মাসে ভারত থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা এলাকায় প্রবেশ করে যুদ্ধ শুরু করে। ওড়াকান্দি মিড হাইস্কুলে কাশিয়ানী মুক্তিযুদ্ধের কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিল গঠন করে ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। ক্যাম্পের দ্বায়িত্বে ছিলেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা নূরুল কাদির জুন্নুর ছোট ভাই ইসমত কাদির গামা। এছাড়াও রামদিয়া এসকে কলেজ, সাজাইল গোপী মহন হাইস্কুল, রাতইল স্কুল, জয়নগর স্কুলসহ অনেক স্থানে মুক্তিযুদ্ধারা ক্যাম্প স্থাপন করে গেরিলা যুদ্ধ শুরু করে। অক্টোবর মাসে উপজেলার ফুকরা লঞ্চঘাট এলাকায় খুলনা থেকে নদী পথে আসা তিন লঞ্চ ভর্তি পাক সেনার সাথে মুক্তি বাহিনীর ৬ ঘণ্টাব্যাপী মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এ সংঘর্ষে পাকবাহিনীর অর্ধশতাধিক সেনা নিহত হয়। বেশ কিছু মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।

গোপালগঞ্জে-ফরিদপুর-নড়াইল জেলার সীমান্তে অবস্থিত এবং ভৌগলিক ও মুক্তিযুদ্ধের দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ রেল স্টেশন ও নদী বন্দর ভাটিয়াপাড়া দখল নিয়ে পাক হানাদার ও মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে লড়াই হয় কয়েক দফা। পাক বাহিনীর ভাটিয়াপাড়া মিনি ক্যান্টনমেন্টটি গোপালগঞ্জের অন্তর্ভূক্ত হলেও গোপালগঞ্জ-ফরিদপুর-নড়াইল অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধাদের লক্ষ্য বস্তু ছিল ভাটিয়াপাড়ার ওই মিনি ক্যান্টনমেন্টটি।

দীর্ঘ ৯ মাসব্যাপী ৬৫ জনের শক্তিশালী পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর একটি গ্রুপ এখানে অবস্থান করে এলাকায় নিরীহ মুক্তিকামী মানুষের উপর নির্যাতন, নিপীড়ন ও হত্যাযজ্ঞ চালায়। অনেক মুক্তিকামী মানুষকে পাকবাহিনী হত্যা করে ভাটিয়াপাড়ার পাড়ে অবস্থিত মধুমতি নদীর পানিতে ফেলে দিতো। ভাটিয়াপাড়ার পাক বাহিনীর ক্যাম্পটি দখল নিয়ে ৬ নভেম্বর দুটি মারাত্মক যুদ্ধ হয়। মুক্তিযোদ্ধা বাবুল, ইসমত কাদির গামার নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর সাথে টানা ১৫ ঘণ্টা পাক বাহিনীর সাথে যুদ্ধ হয়। এ সময় মুক্তিযোদ্ধাদের ঘায়েল করতে পাকবাহিনী আকাশ পথে গুলি ও বোমা বর্ষণ করে। কিন্তু সেদিন অসীম সাহসী মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটেনি। পাকবাহিনী যথেষ্ট ঘায়েল হয় এ যুদ্ধে।

এই ওয়্যারলেস ক্যাম্প দখল নিয়ে দ্বিতীয় দফায় যুদ্ধ হয় ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের দিনে। ৩ দিন যুদ্ধের পর ১৯ ডিসেম্বর খুব ভোরে নড়াইল জেলার দিক থেকে ৮নং সেক্টরের কমান্ডার মেজর মঞ্জুর, নড়াইল জোনের মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার ক্যাপ্টেন হুদা, লে. কর্ণেল জোয়ান, কামাল সিদ্দিকী, গোপালগঞ্জ ও ফরিদপুরের দিক থেকে ক্যাপ্টেন ইসমত কাদির গামা ও বাবুলের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর কমান্ডারগণ সম্মিলিতভাবে ভাটিয়াপাড়ার মিনি ক্যান্টনমেন্টে আক্রমন চালায়।

মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বাত্মক হামলা ও বীরোচিত সাহসী যুদ্ধে অবশেষে ১৯ ডিসেম্বর সকাল ১০টার দিকে মুক্তি ও মিত্র বাহিনীর যৌথ কমান্ডারের কাছে ৬৫ জন পাক সেনা আত্মসর্মপণ করে। এ যুদ্ধে ৬ জন পাক সেনা নিহত হয়। অপরদিকে, কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা নিহত ও আহত হয়। এরপর ভাটিয়াপাড়ার ওয়্যারলেস স্টেশনের মিনি ক্যান্টনমেন্টে উড়ানো হয় লাল-সবুজের পতাকা।