অনলাইন রিপোর্ট॥
আমি জন্মেছি বাংলায় আমি বাংলায় কথা বলি/আমি বাংলার আলপথ দিয়ে হাজার বছর চলি/চলি পলিমাটি কোমলে আমার চলার চিহ্ন ফেলে- কবিতায় নিজের স্বরূপটি এভাবেই তুলে ধরেছিলেন সৈয়দ শামসুল হক। এই সব্যসাচী লেখকের ৮৮তম জন্মদিন আজ।
১৯৩৫ সালের ২৭ ডিসেম্বর তিনি কুড়িগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা সৈয়দ সিদ্দিক হুসাইন ও মা হালিমা খাতুন। সৈয়দ হক তার বাবা-মায়ের আট সন্তানের জ্যেষ্ঠতম। তিনি প্রথিতযশা লেখিকা ও মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. আনোয়ারা সৈয়দ হককে বিয়ে করেন। তাদের এক ছেলে ও এক মেয়ে।
দীর্ঘ ৬২বছরের লেখালেখির জীবনে কবিতা, গল্প, উপস্যাস, প্রবন্ধ, নাটক, চলচ্চিত্র, অনুবাদ, কাব্যনাট্য, গান রচনা সাহিত্যের সবগুলো ক্ষেত্রেই তিনি ছিলেন সফল। এই সাফল্যের কারণেই তিনি সব্যসাচী লেখক হিসাবে সর্বজন সমাদৃত। প্রতিটি ক্ষেত্রেই তিনি অসাধারণ সৃষ্টিশীলতার সাক্ষর রাখেন। তিনি স্বাধীনতা পদক, একুশে পদক ও বাংলা একাডেমি পুরস্কারসহ বিভিন্ন পুরস্কারে ভূষিত হন। মাত্র ২৯ বছর বয়সে বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন।
কুড়িগ্রামে স্কুলজীবন শেষ করেন সৈয়দ হক। এরপর মুম্বাইতে কিছুদিন চলচ্চিত্র প্রযোজনা সংস্থায় কাজ করেন। পরবর্তীতে জগন্নাথ কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হন। সেখানে পড়ালেখা শেষ না করেই পুরোদমে লেখালেখি শুরু করেন। ‘দেয়ালের দেশ’ তার লেখা প্রথম উপন্যাস। কর্মজীবনের প্রায় সাত বছর কাটিয়েছেন লন্ডনে বিবিসি বাংলা বিভাগের সঙ্গে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ে বিবিসি থেকে সংবাদ পরিবেশন করেছেন।
বাংলা সাহিত্য ভাণ্ডার সমৃদ্ধ করে গেছেন তিনি। তার কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে— একদা এক রাজ্যে, বিরতিহীন উৎসব, বৈশাখে রচিত পঙ্ক্তিমালা, প্রতিধ্বনিগণ, অপর পুরুষ, পরাণের গহীন ভিতর, নিজস্ব বিষয়, রজ্জুপথে চলেছি, বেজান শহরের জন্য কোরাস, এক আশ্চর্য সংগমের স্মৃতি, অগ্নি ও জলের কবিতা, কাননে কাননে তোমারই সন্ধানে, আমি জন্মগ্রহণ করিনি, তোরাপের ভাই, শ্রেষ্ঠ কবিতা, রাজনৈতিক কবিতা, নাভিমূলে ভস্মাধার, কবিতা সংগ্রহ, প্রেমের কবিতা, ধ্বংস্তূপে কবি ও নগর।
কাব্যনাট্যেও রয়েছে সৈয়দ শামসুল হকের অনন্য অবদান। পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়, নুরুলদীনের সারা জীবন, এখানে এখন, গণনায়ক প্রভৃতি তার উল্লেখযোগ্য কাব্যনাট্য। ‘কোনটে বাহে জাগো সবায়’ বহুল উচ্চারিত এই সংলাপটি তার ‘নুরুলদীনের সারা জীবন’ নাটকের। গল্পগ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে— তাস, শীত বিকেল, রক্তগোলাপ, আনন্দের মৃত্যু, প্রাচীন বংশের নিঃস্ব সন্তান, সৈয়দ শামসুল হকের প্রেমের গল্প, জলেশ্বরীর গল্পগুলো, শ্রেষ্ঠ গল্প।
তার লেখা উপন্যাসগুলোর মধ্যে রয়েছে— এক মহিলার ছবি, অনুপম দিন, সীমানা ছাড়িয়ে, নীল দংশন, স্মৃতিমেধ, মৃগয়ায় কালক্ষেপ, স্তব্ধতার অনুবাদ, এক যুবকের ছায়াপথ, স্বপ্ন সংক্রান্ত, বৃষ্টি ও বিদ্রোহীগণ, বারো দিনের শিশু, বনবালা কিছু টাকা ধার নিয়েছিল, ত্রাহি, তুমি সেই তরবারী, কয়েকটি মানুষের সোনালী যৌবন, শ্রেষ্ঠ উপন্যাস, নিষিদ্ধ লোবান, খেলা রাম খেলে যা, মেঘ ও মেশিন, ইহা মানুষ, মহাশূন্যে পরাণ মাস্টার, দ্বিতীয় দিনের কাহিনী, বালিকার চন্দ্রযান প্রভৃতি।
১৯৫৯ সালে ‘মাটির পাহাড়’ চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য রচনা করেন সৈয়দ শামসুল হক। তারপর ‘তোমার আমার’, ‘শীত বিকেল’, ‘সুতরাং’, ‘রাজা এল শহরে’, ‘কাগজের নৌকা’, ‘কাঁচ কাটা হীরে’, ‘পুরস্কার’, ‘ক খ গ ঘ ঙ’, ‘বড় ভাল লোক ছিল’সহ আরো বেশ কিছু চলচ্চিত্রের কাহিনি, চিত্রনাট্য ও সংলাপ রচনা করেন তিনি। ‘বড় ভাল লোক ছিল’ ও ‘পুরস্কার’ চলচ্চিত্রের জন্য শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যকার হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন তিনি।
সৈয়দ শামসুল হক রচিত অনেক গান জনপ্রিয়তা পেয়েছে। তার উল্লেখযোগ্য গানগুলো হলো— ‘এমন মজা হয় না গায়ে সোনার গয়না’, ‘এই যে আকাশ এই যে বাতাস’, ‘তুমি আসবে বলে কাছে ডাকবে বলে’, ‘হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস’, ‘তোরা দেখ দেখ দেখরে চাহিয়া’ প্রভৃতি।
তিনি ২০১৬ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে ফুসফুসের ক্যানসারে মারা যান।
আজ সৈয়দ শামসুল হকের জন্মবার্ষিকীতে বাংলা একাডেমিতে আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। বেলা সাড়ে ৩টায় একাডেমির কবি শামসুর রাহমান সেমিনার কক্ষে আয়োজিত হবে অনুষ্ঠান। এ ছাড়া কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজ প্রাঙ্গণে থাকবে দিনব্যাপী সৈয়দ হক মেলা। মেলায় থাকবে স্বরচিত সাহিত্য পাঠ, সৈয়দ হকের লেখা থেকে আবৃত্তি, সংগীত পরিবেশনসহ দিনব্যাপী বইমেলা।