বর্তমান সময়ে বিশ্বের অন্যতম আলোচিত বিষয় হলো ইউক্রেন এবং রাশিয়ার মধ্যকার সংঘাত এবং চলমান যুদ্ধ প্রক্রিয়ার প্রভাব বিদ্যমান সম্পূর্ণ বিশ্বে। পশ্চিমার মদদপুষ্ট ইউক্রেন কোনভাবেই নিজের আধিপত্য ধরে রাখতে পারছে না যখন তখনই পার্শ্ববর্তী ইউরোপ এবং আমেরিকার বিভিন্ন দেশ থেকে তাদেরকে আর্থিক সহায়তা ভারী অস্ত্র দিয়ে সহায়তা প্রদান করা হয় যদিও উক্ত বিষয়ে জাতিসংঘের কোন ভূমিকা পরিলক্ষিত হয়নি এবং এতে যে ভয়াবহ মানব বিপর্যয় ঘটেছে সে বিষয়ে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক কমিশনের যথার্থ পদক্ষেপ নেই যার ফলশ্রুতিতে নিত্যদিন মৃতের সংখ্যা বেড়েই চলেছে।
তবে বর্তমান কালের পর্যালোচনায় দেখা যায় ইউক্রেনের জয়ের পাল্লা অনেকাংশই ভারী রাশিয়ার তুলনায়।
রাশিয়ার মতো সুপারপাওয়ারের তুলনায় ছোট্ট দেশ ইউক্রেইনের যুদ্ধে মস্কোর বিব্রতকর পরাজয় দেশের ভেতরে প্রেসিডেন্ট পুতিনের কর্তৃত্বকে দুর্বল করে দিয়েছে।
রাশিয়ায় ২৩ বছরের শাসনামলে গুরুতর সমস্যায় হাবুডুবু খাচ্ছেন প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। ইউক্রেইনের রণক্ষেত্রে পরাজয়ের জন্য কে দায়ী তা নিয়ে রাশিয়ার অভিজাত মহলে প্রকাশ্য বাকবিতণ্ডা ক্রমেই বাড়ছে।
১৯৯৯ সালের শেষ দিনে বরিস ইয়েলৎসিনের কাছ থেকে পুতিন প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেওয়ার পর তিনি সাবেক গোয়েন্দা, ব্যবসায়ী এবং টেকনোক্রেটদের নিয়ে তার চারপাশ ঘিরে গড়ে তুলেছিলেন নতুন এক অনুগত অভিজাত মহল। যারা সব বিরোধ নিজেদের মধ্যেই সমাধান করতে সম্মত হয়েছিল।
মস্কোয় ঘোঁট পাকিয়ে উঠছে এক সংকটের আবহ, ১৯৯০ এর দশকের বিশৃঙ্খলার পর থেকে যা কখনও অনুভূত হয়নি, আর পুতিন যেটিকে মিটিয়ে ফেলার সংকল্প নিয়েছিলেন।
‘জনস হপকিন্স স্কুল অব এডভান্সড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ’ এর স্নায়ুযুদ্ধ বিষয়ক ইতিহাসবিদ সের্গেই রাদশেঙ্কো বলেছেন, “ইউক্রেইনে রাশিয়ার সামরিক ব্যর্থতায় পুতিনের কর্তৃত্ব ক্ষুন্ন হচ্ছে। ইউক্রেইনে হার যে তার কর্তৃত্ব মারাত্মকভাবে ক্ষুন্ন করবে এই উপলব্ধি খুবই বাস্তব।”
তিনি বলেন, “পুতিনের শাসনামলে রাশিয়া কখনওই মারাত্মক সংকটাপন্ন অবস্থায় ছিল না। কিন্তু এখন সেই মারাত্মক সংকটই আঁচ করা যাচ্ছে। কারণ, প্রতিদিন ইউক্রেইনের যুদ্ধক্ষেত্রে রাশিয়ার অবস্থানের অবনতি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পুতিনের অবস্থানেরও অবনতি হচ্ছে।”
১৯৯৯ সালের পর পুতিন সেই ২০০০ সালের সাবমেরিন ডুবি থেকে শুরু করে মস্কো থিয়েটারে জিম্মিসংকট (২০০২), সরকারবিরোধী বিক্ষোভ (২০১১-১২) পর্যন্ত একের পর এক সংকট সামাল দিয়ে এসেছেন। কিন্তু এমন আর কোনও পরিস্থিতিই তার জন্য আজকের ইউক্রেইন যুদ্ধে সম্ভাব্য পরাজয়ের মতো এতটা হুমকি হয়ে ওঠেনি।
সামরিকভাবে পিছিয়ে থাকা কিন্তু দৃঢ়প্রতিজ্ঞ শত্রুর বিরুদ্ধে রাশিয়াকে এখন ন্যাক্কারজনকভাবে মূল্য দিতে হচ্ছে। লড়াইয়ে অপমানজনক পরিস্থিতিতেও পড়তে হচ্ছে তাদের।
ইউক্রেইনের উত্তর-পূর্ব এবং দক্ষিণে রুশ বাহিনীর পরাজয় হয়েছে। ইউক্রেইন যুদ্ধে সাম্প্রতিক সময়ে সুবিধা করতে না পারার মধ্যে শনিবার রাশিয়া যুদ্ধ পরিচালনার নেতৃত্ব বদলে নতুন কমান্ডারও নিয়োগ করেছে।
‘আর.পলিটিক’ পলিটিক্যাল কনসালটেন্সির প্রধান রুশ রাজনীতি বিশেষজ্ঞ তাতিয়ানা সাতানোভায়া বলেছেন, “পুতিন সামরিক পরিস্থিতির জিম্মি। গত ২৪ ফেব্রুয়ারির পর তিনি অনেক বেশি দুর্বল হয়ে পড়েছেন।
খুব বেশি দুর্বল কিংবা এমনকী মরিয়া হয়ে পুতিন ইউক্রেইন যুদ্ধে আরও বেশি বিপজ্জনক অধ্যায়ের সূচনা করে বসতে পারেন। আর সেটি হচ্ছে পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহার।
ইউক্রেইনের চারটি অঞ্চলকে রাশিয়ার নতুন ভূখন্ড হিসেবে ঘোষণা করার পর পুতিন পশ্চিমাদের সতর্ক করে বলেছেন এসব অঞ্চলে হামলা হলে তা রাশিয়ার ওপর হামলা হিসেবেই বিবেচিত হবে এবং এর জবাব পারমাণবিক অস্ত্রে দেওয়া হতে পারে।
পুতিন পশ্চিমাদের হুঁশিয়ার করে এও বলেছেন যে, যখন তিনি বলেন রাশিয়াকে রক্ষা করতে তিনি পরমাণু অস্ত্র ব্যবহার করতে প্রস্তুত আছেন সেটা যেন তারা ‘ধাপ্পা’ বলে ধরে না নেয়।
রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মারিয়া জাখারোভা অবশ্য বৃহস্পতিবার বলেছেন, ‘পারমাণবিক যুদ্ধ কখনওই লড়তে নেই’- রাশিয়ার এই অবস্থান বদলায়নি।
কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র পুতিনের হুঁশিয়ারিকে গুরুত্বেরই সঙ্গে নিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন দুদিন আগেই বলেছেন, কিউবার মিসাইল সংকটের পর এ ধরনের সবচেয়ে বড় হুমকি নিয়ে আসার ঝুঁকি তৈরি করেছে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের হুঁশিয়ারি।
ইউক্রেনে যুদ্ধের জন্য সামরিক প্রস্তুতি নিয়ে মাত্রাতিরিক্ত ধারণা করেছিলেন প্রেসিডেন্ট পুতিন। রুশ সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠায় নাগরিকদের আকাঙ্ক্ষাকেও তিনি ভুলভাবে বিবেচনা করেছেন।
সার্বিক পর্যালোচনায় প্রতিয়মান হয় যে, যতটুকু ঘটেছিল তা যুদ্ধ পর্যন্ত গড়ানোর কোন অত্যাবশকতা ছিল না। কিন্তু পশ্চিমা বিশ্বের অপকূট চালে এবং উস্কানিমূলক কর্মকান্ডের জন্য রাশিয়া তার নিজের দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার্থে ইউক্রেনীয়দের সাথে যুদ্ধে জড়ায়।
ইউক্রেইনের লিমান শহর রুশ বাহিনীর হাতছাড়া হওয়ায় ক্ষুব্ধ হয়েছেন পুতিনের কট্টরপন্থি দুই মিত্র চেচেন নেতা রামজান কাদিরভ এবং মারসিনারি ওয়াগনার গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা ইভগেনি প্রিগোজিন। লিমানের দখল খোয়ানোয় রাশিয়ার সঙ্গে যুক্ত হওয়া লুহানস্ক অঞ্চলের পশ্চিমাঞ্চল হুমকির মুখে পড়েছে।
রাশিয়ার এমন শোচনীয় পরিস্থিতিতে পুতিনমিত্র কাদিরভ এবং প্রিগোজিন শীর্ষ রুশ জেনারেলদের ব্যাঙ্গ করে বলেছেন, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের পদবী কেড়ে নেওয়া উচিত। সামরিক বাহিনী স্বজনপ্রীতিতে ভরে গেছে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
ইতিহাসবিদ রাদশেঙ্কোর মতে, “কাদিরভের এই সমালোচনায় সম্ভবত মস্কোয় তলে তলে চলতে থাকা ক্ষমতার লড়াইয়ের প্রতিফলন ঘটেছে- এমন দৃষ্টিভঙ্গি যে কেবল তিনিই প্রকাশ করছেন তা নয়।”
রাশিয়ার শীর্ষ জেনারেলদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যেই এমন ক্ষোভের মধ্যে প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই শোইগু প্রচ্ছন্নভাবে পুতিনের জন্য আরেক সমস্যা হয়ে বিরাজ করছেন। যুদ্ধ চলার মাঝখানে শীর্ষ কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করে সামরিক বাহিনীর বিরাগভাজন হবেন, নাকি দোষ নিজের ঘাড়ে নেওয়ার ঝুঁকি নেবেন? তা নিয়ে ধন্দ্বে পড়েছেন তিনি।
পুতিনের ঘনিষ্ঠ মিত্রদের অন্যতম শোইগু। ২০১২ সালে তাকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। ছুটির দিনগুলো নিয়মিতই একসঙ্গে কাটিয়ে এসেছেন দুইজন।
পুতিনমিত্র কাদিরভের সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আছেন আরও এক সামরিক কর্মকর্তা। তিনি হচ্ছেন রাশিয়ার চিফ অব জেনারেল স্টাফ ভ্যালেরি গেরাসিমভ। রাশিয়া পারমাণবিক যুদ্ধ শুরু করতে চাইলে গেরাসিমভ এবং শোইগু দুইজনেরই প্রয়োজন পড়বে।
ক্রেমলিনের সাবেক একজন বক্তৃতা লেখক আব্বাস গালিয়ামোভ বলেছেন, “অভিজাত মহলের মধ্যে ফাটল উত্তরোত্তর বাড়ছে।”
“সেনাবাহিনী যুদ্ধের সম্মুখসারিতে স্থিতিশীলতা আনতে পারলেও তাতে অনেক সময় লাগতে পারে। কিন্তু যুদ্ধে এমন একটি মুহূর্ত আসবে যখন পুতিন যুদ্ধ শেষ করতে পারবেন না, আবার তা চালিয়েও যেতে পারবেন না।
যুদ্ধ দ্বন্দ্ব সংঘাত কোন সময়ই কল্যাণ বয়া আনতে পারে না। রাশিয়া এবং ইউক্রেন যুদ্ধের ক্ষতিকর প্রভাব সমগ্র বিশ্ববাসীকে পোহাতে হবে দীর্ঘকাল ধরে। জাতিসংঘের মতো এত বৃহৎ একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা উক্ত যুদ্ধের সমাধান ঘটাতে কোন বিশেষ ভূমিকাই আজ অবধি পালন করতে পারল না যা খুবই হতাশাজনক।
Attachments area